আজকের শিরোনাম :

ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন -একটি সতর্ক প্রতিক্রিয়া।  

  আলাউদ্দিন মল্লিক

০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩:২৫ | অনলাইন সংস্করণ

আলাউদ্দিন মল্লিক
মুয়াবিয়ার নীতি:
"হয় তুমি আমার দলে; নয়ত শত্রু " - পঞ্চম মুসলিম খলিফা হজরত মুয়াবিয়ার এই নীতি মূলত পৃথিবীর সব শাসকের মূলমন্ত্র।  চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর মৃত্যুর পরে নানা ফন্দি-ফিকির আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হন  এই শাসক।  ক্ষমতা গ্রহণ করে তাকে পারিবারিক করার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয় এই খলিফা। তার ভয় ছিল যে কোন সময় তার আসন উল্টে যেতে পারে।  তাই, তিনি ভিন্ন মতের কোন মূল্যায়ন করতেন না।  তার কাছে বিষয়টি ছিল এমন- হয় তুমি আমার স্বার্থ দেখবে; নয়ত তোমাকে আমার শত্রু হিসেবে গণ্য করে দমন করা হবে।  

ভিন্ন মতের গুরুত্ব:
পৃথিবীর সভ্যতার অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি হল এই ভিন্ন মতগুলো। দাস সমাজের প্রায় শুরু হতেই এর কুফল আর মানবতার মুক্তির কথা ভিন্ন মতাবলম্বীরাই বলে এসেছেন।  হয়ত সময় লেগেছে; কিন্তু শেষে তাদের মতের জয় হয়েছে- দাস সমাজ টিকে থাকতে পারে নাই।  আজকের এই আলোচনাটি আপাত দৃষ্টিতে অনেকের কাছে অপছন্দ হবে; কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকের এই সতর্ক প্রতিক্রিয়া একটি একাডেমিক আলোচনা হিসেবে গ্রহণের আহবান থাকল।  

ব্রিটিশ পণ্য বর্জন: 
ব্রিটিশ পণ্য বর্জন আন্দোলন ১৯২০ সেপ্টেম্বর হতে ১৯২২ এর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারা ভারতকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায় - এর ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধী যুগের শুরু হয়। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে রাওলাট আইনের ভারতে  বলবৎ ঘোষণার প্রতিবাদ হিসেবে। এই আইনবলে ভারতবাসীর উপর দমনমূলক নানা বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়, ন্যূনতম প্রমাণ দাখিল ব্যতিরেকেই সেনা ও পুলিশকে সাধারণ ভারতীয়দের গ্রেফতার, কয়েদ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই আইনে বিনা বিচারে শুধু সন্দেহের উপর ভিত্তি করে দুই বৎসর পর্যন্ত কারাদন্ড দেয়ার বিধান ছিল। 
গান্ধীর প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছিলেন কিছু দিন অধ্যাপক নির্মল কুমার বসু। তিনি গান্ধীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিদেশী পণ্য বর্জন আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে, তাছাড়া চরকা দিয়ে সুতো তৈরি করা মূলত সময় নষ্ট। তারপরেও কেন তিনি এ কাজ করতে মানুষকে বলছেন? আর নিজেও কেন করেন? গান্ধী উত্তর দিয়েছিলেন, এর ভেতর দিয়ে মনসংযোগ বাড়ে। (সূত্র: ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন বনাম টুপি উদ্ধার  - অনলাইন পোর্টাল - sarakhon.com)

ফরাসি পণ্য বর্জন আন্দোলন:
ফরাসি পণ্য বর্জন আন্দোলন হল শার্লি এবদো ম্যাগাজিনে নবী মুহাম্মাদের ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশ, দুটি ভবনে তা প্রদর্শন ও তাতে ফরাসি রাষ্ট্রপতির সমর্থন জানানোর প্রতিবাদে ২০২০ সালের অক্টোবরে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হওয়া একটি আন্দোলন। কিন্তু এর ফলাফল মোটেই আশাপ্রদ নয়; কারণ সারা মুসলিম বিশ্বের ফরাসি পণ্য বর্জনটি শুধু ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে।

আন্দোলনের ভবিষ্যৎ:
বিশিষ্ট সাংবাদিক স্বদেশ রায় শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪ সারাক্ষন (sarakhon.com) অনলাইন পোর্টালে "ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন বনাম টুপি উদ্ধার" শিরোনামে লেখায় উল্লেখ করেন, "তবে এই সত্য সবাই স্বীকার করবেন যে, ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন সফল হবে না এবং এ নিয়ে কোন্ এনার্কিও হবে না। কারণ যে পণ্য মানুষের নিত্য দিনের প্রয়োজন ও দামে সুলভ তা কখনই কোন বাজার থেকে তোলা যায় না।"

অসামঞ্জস্য আহবান:
গত পনের বৎসর সময়ব্যাপী প্রধান বিরোধী দলসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল  আর নেতারা তেমন কোন কার্যকরী আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি।  অনেকবার তাদের দেয়া চূড়ান্ত কর্মসূচি জনগণের সাড়া না পেয়ে ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছে। জনগণ কতটা হতাশ বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা পরিমাপ না করতে পারলেও বর্তমান সরকার বিরোধীদের আর তাদের নেতাদের হতাশাটা এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে নিজ দেশ আর জনগণের উপর কোন আস্থাই রাখতে না পেরে পার্শ্ববর্তী দেশের উপর পুরোপুরি নিজেদের অক্ষমতার দায় চাপিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীর বিদ্যমান পরিস্থিতি কিছু প্রভাবশালী দেশকে অন্য দেশগুলোর উপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ করে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপর আমাদের পার্শবর্তী দেশটিও এমনটি করে আসছে। 

অনেক সময় নিকট অসম্ভব টার্গেটকে দূরে সরিয়ে আরো বড় আর  দূরবর্তী টার্গেটকে জনগণের সামনে নিয়ে এসে নেতৃবৃন্দ নিজেদের অক্ষমতাকে ঢাকার প্রয়াস পান।  তাইতো দেশের ক্ষমতায় ক্ষমতাসীনদের বিপরীতে পাশের দেশটির নেতৃত্বকে প্রধান টার্গেট বানিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে বজায় রাখার অক্ষম চেষ্টা করে চলেছেন।

আন্দোলনের কারিগররা:
অনলাইন এক্টিভিস্ট এবং ইউটুবাররা মূলত এই আন্দোলনের উদ্যোক্তা - যার মধ্যে প্যারিস প্রবাসী পিনাকী ভট্টাচার্য প্রায় একক কৃতিত্বের দাবিদার। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিদেশে এনং দেশে থাকা অজস্র অনলাইন  এক্টিভিস্ট এবং ইউটুবাররা।  দেশের বহু মানুষ এর সাথে যুক্ত হয়েছেন একটি মহৎ আকাঙ্খায়। কিন্তু এই সব অনলাইন একটিভিস্ট আর ইউটুবাররা নিকট অতীতে (অন্তত বিগত অর্ধযুগ) যেভাবে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সত্যের সাথে মিথ্যাকে মিশিয়ে অনলাইন-এ সরকারকে উৎখাত করে চলছিলেন তাতে নিজেদের এবং বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছেন।  জনগণ এদের প্রচারণা আমলে নেয়নি; বরং নিজেদের ক্রমাগত বিতর্কিত করে ফেলেছেন।  

সতর্ক প্রতিক্রিয়া:
রাজনীতির বিষয়গুলো রাজনীতির মাঠেই ফয়সালা হওয়া উচিত।  এর সাথে অর্থনীতি, ধর্মীয় আবেগ আর আন্তঃদেশীয় বিষয় যুক্ত করলে শেষ বিচারে নিজেদেরই ক্ষতি করা হয়।  কল্পনার খাতিরে ধরা যাক- এই আন্দোলনটি সফল হল- তখন আমাদের পার্শবর্তী দেশটি তার ক্ষতির (যেভাবে অনলাইন এক্টিভিস্ট আর ইউটুবাররা তথ্য দিয়েছে) কারণ হিসেবে কাকে দায়ী করবে? আর এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশটির জন্য আদৌ কি শুভ হবে - যাই ভাবা হোক না কেন পার্শবর্তী দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি বড় ফ্যাক্টর। তখনকার সময়ে একটি ছোট দেশ হিসেবে কিভাবে পার্শবর্তী বড় আর শক্তিশালী দেশের সাথে পেরে উঠবে।  উল্লেখ্য যে, বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলোর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির কারণে পার্শবর্তী দেশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। 
প্রথমত, বিশ্বের বর্তমান অর্থনীতিতে কমদামি আর প্রচলিত পণ্য কোনভাবেই বাজার থেকে সরানো যায়না; হয়ত কিছুটা সময় একটি আবেগপ্রবন হয়ে নিজের মনে মনে খুশি হওয়া যায়। বর্তমান যুগে জনগণ এতটা দেশপ্রেমিক নয় যে, দীর্ঘদিন আর্থিক ক্ষতি মেনে নেবে। 
দ্বিতীয়ত, যেহেতু বিশ্ব রাজনীতি আর অর্থনীতিতে আমাদের ভূমিকা নগন্য আর পার্শবর্তী দেশটির গুরুত্ব এতই বেশি যে, শেষ বিচারে তাদের সাথে একটি সমঝোতা করেই আমাদের এগোতে হবে। 
তৃতীয়ত, অনলাইন এক্টিভিস্ট এন্ড ইউটুবারতা সবাই যেমন  দাবি করেছে, তেমনটি হলে বর্তমান সরকারের মাধ্যমেও বিষয়টিকে জয়ী হতে দেবে না। 
সর্বশেষে, বর্তমান সময়ে সরাসরি বিরোধিতা করাটা যৌক্তিক নয়; বরং আলোচনার মাধ্যমে যৌথভাবে লাভবান হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।  আর এটাই একটি পরিণত দেশ আর সমাজের পরিচায়ক।

আলাউদ্দিন মল্লিক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।

এই বিভাগের আরো সংবাদ